আন্তর্জাতিক :- বৃদ্ধ হতে চান না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বার্ধক্যকে থামিয়ে দিতে চান একই জায়গায়। বরং বয়সের কাঁটা ঘুরবে বিপরীতে। বার্ধক্যের দোরগোড়ায় আসামাত্রই জীবনের চাকা মুখ ঘুরিয়ে গড়গড়িয়ে পিছন দিকে চলবে। অর্থাৎ, ফিরে যাওয়া যাবে যৌবনে। ক্ষমতা ও শক্তিকে বশে রাখতে বার্ধক্যের সঙ্গেই যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। বিজ্ঞানী-চিকিৎসকদের ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে নির্দেশ জারি করেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুবক হওয়ার ওষুধ আবিষ্কার করতে হবে। জলে নেমে হোক, পাতাল ফুঁড়ে হোক অথবা পৃথিবীর আনাচকানাচ ঘুরে, বয়স কমানোর কৌশল খুঁজে বার করতেই হবে। সোজা কথায় বললে, অমর হওয়ার বাসনাই প্রকাশ করেছেন পুতিন।
বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখার এই যে অদম্য বাসনা, এর থেকেই ‘অ্যান্টি-এজিং’ নিয়ে গবেষণা চলছে বিশ্ব জুড়েই। তবে শরীরে বয়সের ছাপ লুকিয়ে রাখার ‘অ্যান্টি-এজিং থেরাপি’ এক রকম, আর একেবারে বুড়ো থেকে যুবক হয়ে ওঠার পদ্ধতি আবার সম্পূর্ণই ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে, গোটা ব্যাপারটাই হল প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে কারসাজি করা। তাতে এক দিকে যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু প্রক্রিয়া করতে হবে, তেমনই চারপাশের বাস্তুতন্ত্রেও অনেক বদল আসবে।
এখন কথা হল, বার্ধক্যকে কি সত্যিই থামিয়ে দেওয়া সম্ভব? এই বিষয়ে স্ত্রীরোগ চিকিৎসক ও রিজেনারেটিভ মেডিসিন নিয়ে গবেষণারত মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “আজ না হলেও আগামী দিনে বয়সের চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি যে আবিষ্কার হবে না, তা বলা যায় না। স্টেম কোষ প্রতিস্থাপন এবং ক্লোনিং, এই দুই প্রক্রিয়ায় অসাধ্যসাধন সম্ভব। যদিও তা পুরোপুরি অনৈতিক ও প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ।”
চিকিৎসক বুঝিয়ে বললেন, জীববিজ্ঞানে ‘ক্লোনিং’ বলে একটি পদ্ধতি আছে, যেখানে কোনও প্রাণীর একেবারে অবিকল ও অনুরূপ প্রতিলিপি তৈরি করা যায়। আর তা হয় স্টেম কোষের মাধ্যমে। এই স্টেম কোষ শুধু যে ভ্রুণে থাকবে তা নয়, রক্ত, শরীরের ফ্যাটেও থাকে। সেখান থেকেও স্টেম কোষ নিয়ে সেই প্রাণীর মতোই আরও একটি প্রাণী তৈরি করা সম্ভব। যেমন হয়েছিল ‘ডলি’ বলে একটি ভেড়ার ক্ষেত্রে। এর পর নানা সময় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের (কুকুর, বিড়াল, হরিণ, খরগোশ, গিনিপিগ) ক্লোন তৈরি করেছেন। তবে কোনও গবেষণাই দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য পায়নি। সব ক’টি ক্ষেত্রেই ক্লোনজাত প্রাণীর মধ্যে কোনও না কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা গিয়েছে। ১৯৯৮ সালে আমেরিকার উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস থমসন ক্লোনিংয়ের সাহায্যে মানবভ্রুণের কোষ তৈরি করেন। তবে সেই গবেষণা সাফল্য পায়নি। অনৈতিক আখ্যা দিয়ে ক্লোনিং নিয়ে গবেষণা থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদি মানুষের উপর ক্লোনিং-এর গবেষণা সাফল্য পেত, তা হলে স্টেম কোষ দিয়েই বয়সকে থামিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি বেরিয়ে যেত। সময়ান্তরে বার বার স্টেম কোষ প্রতিস্থাপন করে বয়সের চাকা একই জায়গায় থামিয়ে রাখার কৌশলও আয়ত্ত হত।
মল্লিনাথের কথায়, আরও একটি পদ্ধতি নিয়ে বিশ্ব জুড়েই গবেষণা চলছে, তা হল জিনবিদ্যার সাহায্যে ক্রোমোজ়োমের অদলবদল ঘটিয়ে বার্ধক্যকে থামিয়ে দেওয়া। মানুষের শরীরে প্রতি দশ বছর অন্তর হার্ট, লিভার, কিডনি, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ৫-১০ শতাংশ হারে কমতে থাকে। সাধারণত ৩০ বছরের পর থেকেই এই ক্ষয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাই দেখা যায়, ৫০ বছরে গিয়ে হয়তো শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির ক্ষমতা প্রায় ২০ শতাংশ কমে গিয়েছে। ৮০ বছরে গিয়ে তাই ৫০ শতাংশ বা তার বেশি কমে যাবে। এর কারণ হল, কোষের ক্ষয় ক্রমাগতই হয়ে চলেছে।
কোষের মূল জিনগত উপাদান হল ক্রোমোজোম। দেখতে ‘এক্স’-অক্ষরের মতো। এর দুটি বাহু, ছোটটির শেষ প্রান্তকে বলে টেলোমিয়ার। ক্ষয়টা হয় এখানেই। কোষ কত বার বিভাজিত হবে তার হিসেব আছে। যখন বিভাজন প্রক্রিয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে, তখনই কোষের মৃত্যু হবে। এই প্রক্রিয়াকেই ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন বিজ্ঞানীরা। টেলোমিয়ারের ক্ষয় বন্ধ হয়ে যাবে, কোষের মৃত্যুও হবে না। শরীরে ক্ষয়ও হবে না। সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একই রকম কার্যক্ষম থাকবে বছরের পর বছর। যার ফলে মানুষ আর বুড়োই হবে না। কিন্তু এই প্রক্রিয়া আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভবই। আর অদূর ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়া যদি মানুষের হাতে চলে আসে, তা হলে আর মানুষ নয়, অতিমানব তৈরি হবে। বাস্তুতন্ত্র পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে।
কোষের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে কোষের ক্ষয় দীর্ঘসময় ধরে আটকে রাখা সম্ভব, কিন্তু বার্ধক্যকে একেবারে যৌবনে বদলে দেওয়া সম্ভব নয়, এমনটাই মত বার্ধক্য বিজ্ঞান বিশারদ ধীরেশ চৌধুরির। তিনি বলছেন, কোষের যাবতীয় শক্তির জোগান আসে মাইটোকনড্রিয়া থেকে। এমন একটি প্রোটিনের খোঁজ পাওয়া গেছে যা এই মাইটোকনড্রিয়ার শক্তি বাড়িয়ে তার ক্ষয় প্রতিরোধ করতে পারে। এই প্রোটিনের নাম ‘এটিএসএফ ১’। এর কাজই হল কোষকে দীর্ঘজীবী করা। এই বিশেষ প্রোটিন নিয়ে গবেষণা চলছে বিশ্বের অনেক জায়গাতেই। ধীরেশের কথায়, জিনবিদ্যার সাহায্যে এই প্রোটিনকে কাজে লাগিয়ে মানুষের যৌবন দীর্ঘ সময় ধরে রাখার চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রেখে, সুষম আহার ও শরীরচর্চার মাধ্যমেও দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকা সম্ভব।
স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অনিমেষ করের বক্তব্য, “শরীরের বয়স ধরে রাখতে শরীরচর্চা, পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া ও মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখা জরুরি। কম বয়স থেকে জীবনকে নিয়মে বাঁধলে, বার্ধক্য আসবে অনেক দেরিতে। কিন্তু বয়স কমিয়ে দেওয়ার এই ইচ্ছা একেবারে হাস্যকর ও অযৌক্তিক। অবৈজ্ঞানিকও বটে। এমন গবেষণা করাও উচিত নয়।”
রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ যে ভাবে হচ্ছে, তাতে বয়স কমিয়ে যৌবন ধরে রাখার কৌশল হয়তো আবিষ্কার হয়েই যাবে কিন্তু তা নীতিসম্মত হবে না, এমনটাই মত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের প্রাক্তন বিজ্ঞানী দীপিকা সুরের। তাঁর মতে, “যে কোনও গবেষণাই পশুদের উপর ট্রায়াল করে দেখা হয়। জিনের যা যা গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে, প্রতিটাই গবেষণাগারে পশুদের উপর পরীক্ষানিরীক্ষার পরে তবেই মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়। এখন বলুন তো, বয়স কমিয়ে দেওয়ার গবেষণা কার উপরে প্রয়োগ করা হবে? আর কত বছর ধরে? তিনি আদৌ বুড়ো হচ্ছেন, না কি যুবকই থাকছেন, তা পর্যবেক্ষণ করবে কে? এক জন মানুষের গোটা জীবনকাল তো আর পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয়। তাই এই ইচ্ছাই অবাস্তব।”
ক্যানসার চিকিৎসক শুভদীপ চক্রবর্তী মনে করছেন, কোষের বিভাজন স্তব্ধ করে তাকে বিপরীতমুখী করা সম্ভবই নয়। কোষের অনিয়মিত বিভাজন শুরু হয়ে গেলে, তখন ক্যানসার কোষ তৈরি হয়। ক্যানসার কখন, কার হবে তা ধরাও সম্ভব নয়। সেখানে কোষের কার্যকলাপের পদ্ধতিই বদলে দেওয়া, এতটা সহজসাধ্য হবে না। তা ছাড়া, বয়সও একটা বিষয়। শুভদীপ বলছেন, পুতিনের বয়স ৭০ পেরিয়েছে। সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ যদি হঠাৎ চান তাঁর শরীরের সব কোষের গতি উল্টো পথে চলবে, তা তো আর হয় না। কারণ, যে সব কোষ, কলা দিয়ে মানুষ-সহ বিভিন্ন প্রাণীর দেহ গড়ে ওঠে, উত্তরোত্তর বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলাই তাদের অনিবার্য পরিণতি। এর ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভবই নয়।